ইখলাস, কেন ও কিভাবে(১০ পৃষ্ঠার অসাধারণ এই বইটির পিডিএফ ডাউনলোড করুন 328.2kb)
[এখানে আপনাদের সাথে পিডিএফ পৃষ্ঠা ৮-১০ শেয়ার করা হল]
ইবাদত ও কাজে কর্মে বান্দার একনিষ্ঠতা এবং বিশুদ্ধ নিয়ত তার পার্থিব কর্মগুলোকে উঁচু স্তরে উন্নীত করে এবং পরিণত করে গ্রহণযোগ্য ইবাদতে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- “আর তোমাদের যৌনাঙ্গেও রয়েছে পূণ্য। সাহাবাগণ বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ ! আমাদের কেউ যদি তার যৌন চাহিদা পূর্ণ করে তাহলেও কি পুরষ্কার? তিনি বললেন, আচ্ছা তোমার মত কি; যদি কেউ অবৈধ পন্থায় যৌন চাহিদা মেটায় তাহলে তার কি পাপ হবে? এমনিভাবে যদি কেউ বৈধ পন্থায় তার যৌন চাহিদা পূর্ণ করে তাহলে পুরষ্কার পাবে।” (মুসলিম)
কেন সে বৈধ পন্থায় যৌন চাহিদা মেটালেও সওয়াব পাবে? কারণ সে কাজটি করার সময় এ ধারণা করেছে যে, আমি বৈধ পন্থায় কাজটি করে সেই অবৈধ পন্থা থেকে বেঁচে থাকব, যেখানে আল্লাহ আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হবেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এ অসন্তুষ্টি থেকে বেঁচে থাকার মাধ্যমে আমি তার প্রতি একনিষ্ঠ (মুখলিস) হতে পারব। আর এ ইখলাস প্রসূত ধারণার কারণেই তার সামান্য মানবিক চাহদা মেটানোর কাজটাও সওয়াবের কাজ হিসেবে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে যাবে।
হাদীস থেকে আরেকটি দৃষ্টান্তঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন; “তুমি যা কিছু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়্যতে খরচ করবে অবশ্যই তার পুরষ্কার পাবে। এমনকি, তুমি যা কিছু তোমার স্ত্রীর মুখে দিয়েছ তারও সওয়াব পাবে।” (বুখারী)
স্ত্রী সন্তানদের জন্য খরচ করা পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব। এখানে পাপ-পুণ্যের কি আছে? তবু দেখুন, যদি কোন ব্যক্তি তার স্ত্রী সন্তানদের জন্য খরচ করার সময় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়্যত করে তাহলে সে সওয়াব ও পুরষ্কার পেয়ে যাচ্ছে।
এমনিভাবে যদি কেউ নিজের খাওয়া-দাওয়ার জন্য ব্যয় করে এবং এর সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়্যত করে, তাহলে সে সওয়াব লাভ করছে। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি কোন বৈধ মানবিক চাহিদা মেটাতে গিয়ে ইবাদত-বন্দেগীতে সামর্থ হাসিলের নিয়্যত করবে তার এ চাহিদা পূরণের কাজটা আল্লাহর কাছে ইবাদত হিসেবে কবুল হবে ও সে এতে সওয়াব পাবে। (মজমু’ আল-ফাতাওয়াঃ ইবনে তাইমিয়া)
যেমন আপনি নিয়্যত করলেন যে, আমি এখন বাজারে কেনা-কাটার জন্য যাব। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য হল এ কেনাকাটার মাধ্যমে আমি খেয়ে দেয়ে যে শক্তি অর্জন করব তা আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালনের ক্ষেত্রে ব্যয় করব। ব্যস! আপনার এ নিয়্যতের কারণে বাজারে কেনা-কাটা করাটা আপনার ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে। এটাইতো ইখলাস বা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ হওয়া।
ইখলাস যেমন সাধারণ বৈধ কাজকে ইবাদতে রূপান্তরিত করে, তেমনি রিয়া বা লোক দেখানো উদ্দেশ্যে ইবাদতকে বরবাদ করে প্রতিফল শূন্য করে দেয়। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ ” হে মুমিনগণ! দানের কথা বলে বেড়িয়ে এবং ক্লেশ দিয়ে তোমরা তোমাদের দানকে ঐ ব্যক্তির ন্যায় নিস্ফল করো না, যে নিজের ধন লোক দেখানোর জন্য ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকাল দিবসে ঈমান রাখে না।” (সূরা বাকারাঃ ২৬৪)
অর্থাৎ দানের কথা বলে বা খোঁটা দিয়ে যেভাবে দানের প্রতিফলকে ধ্বংস করা হয়, তেমনি মানুষকে দেখানোর বা শুনানোর জন্য দান করলে আল্লাহর কাছে তার প্রতিদান পাওয়া যায় না। বাহ্যিক দিক দিয়ে যদিও মনে হবে সে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য দান করেছে, কিন্তু তার উদ্দেশ্য হল মানুষের প্রশংসা অর্জন। মানুষ তাকে দানশীল বলবে, তার দানের কথা প্রচার হলে মানুষ তাকে সমর্থন দিবে-ইত্যাদি।
সাহাবী উবাদাহ ইবনু সামেত রাদিয়াল্লাহু আনহুকে এক ব্যক্তি বলল, আমি আমার এ তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করব। এর মাধ্যমে আমি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করব ও মানুষের প্রশংসা পাব। উবাদাহ তাকে বললেন, তুমি কিছুই পাবে না। তুমি কিছুই পাবে না। তৃতীয়বার উবাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আল্লাহ বলেছেন; “আমি শিরক ও অংশীদার থেকে বেপরোয়া। যে ব্যক্তি আমার জন্য করা হয় এমন কোন কাজে আমাকে ব্যতীত অন্য কাউকে শরীক করল আমি তার থেকে সম্পর্কমুক্ত। আমাকে ছাড়া যার জন্য সে করেছে সেটা তারই জন্য বিবেচিত।” (ইহইয়া উলুমুদ্দিন; আল-গাযযালী)
- ইখলাসপূর্ণ নিয়্যতের মাধ্যমে পরিপূর্ণ আমলের সওয়াব অর্জন
কোন কোন সময় মানুষ ইখলাস ও বিশুদ্ধ নিয়্যতে কাজ করতে উদ্যোগী হয়, কিন্তু তার সম্পদের সীমাবদ্ধতা, শারীরিক দুর্বলতা ইত্যাদির কারণে কাজটি সমাধা করতে পারে না। কখনো দেখা যায়, উক্ত ভাল কাজটি করার জন্য সে প্রবল প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, কিন্তু কোন কারণে কাজটি আঞ্জাম দিতে পারেনি। এমতাবস্থায় সে কাজটি সম্পন্ন করার সওয়াব পেয়ে যাবে এবং তার ইখলাসে কারণে কাজটি যারা করতে পেরেছে তাদের সমমর্যাদা লাভ করবে।
যেমন নবী কারীম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আমরা কয়েকটি দলকে মদীনায় রেখে এসেছি। তারা আমাদের সাথে কোন পাহাড় অতিক্রম করেনি, কোন উপত্যকাও মাড়ায়নি। অথচ তারা আমাদের সাথে অংশগ্রহণকারীর সমান মর্যাদা লাভ করবে। অক্ষমতা তাদেরকে আটকে রেখেছে। (বুখারী)
হাদীসে বর্ণিত সাহাবীগণ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর সাথে অভিযানে অংশ নিতে পারেননি কোন অসুবিধার কারণে। কিন্তু তাদের বিশুদ্ধ নিয়ত ও ইখলাস ছিল অভিযানে অংশ নেয়ার জন্য। তাই তারা অংশ গ্রহণ না করেও অংশগ্রহণকারীদের সমান মর্যাদার অধিকারী হবেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেনঃ “যে ব্যক্তি শেষ রাতে তাহাজ্জুদ আদায় করবে- এ নিয়্যতে শুয়ে পড়ল। অবশেষে নিদ্রা তাকে কাবু করে ফেলল, এবং সকাল হওয়ার আগে জাগতে পারল না। এমতাবস্থায় সে যা নিয়ত করেছিল তা তার জন্যে লেখা হয়ে যাবে। এবং এ নিদ্রা তার প্রভুর পক্ষ থেকে দান হিসেবে ধরা হবে।” (নাসায়ী)
তাহাজ্জুদের নিয়ত করেও এ ব্যক্তি তাহাজ্জুদ পড়তে পারল না বটে কিন্তু ইখলাস ও বিশুদ্ধ নিয়তের কারণে সে তাহাজ্জুদের পূর্ণ সওয়াব পাবে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেনঃ “যে বিশুদ্ধ মনে জিহাদে শরীক হয়ে আল্লাহর কাছে শহীদ হওয়া কামনা করবে, আল্লাহ তাকে শহীদের মর্যাদা দান করবেন যদিও সে বিছানায় মৃত্যুবরণ করে”। (মুসলিম)
ইখলাস বা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে যে শহীদ হওয়ার আকাংক্ষা করবে, সে শহীদ না হতে পারলেও আল্লাহ তাকে তার ইখলাসে কারণে শহীদের সমান মর্যাদা দান করবেন।
আরেকটি হাদীস উল্লেখ করা যেতে পারে, তা হল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
এক ব্যক্তি নিয়ত করল যে, আমি রাতে কিছু সাদাকাহ(দান) করব। যখন রাত এল সে সাদাকাহ করল। কিন্তু সাদাকাহ পড়ল এক ব্যভিচারী মহিলার হাতে। সকাল হলে লোকজন বলতে শুরু করল, গত রাতে জনৈক ব্যক্তি এক ব্যভিচারীকে সাদাকাহ দিয়েছে। এ কথা শুনে দানকারী বলল, হে আল্লাহ ! ব্যভিচারীকে সাদাকাহ দেয়ার ব্যাপারে তোমারই প্রশংসা।
আমি রাতে আবার একটি সাদাকাহ করব। পরের রাতে যখন সে সাদাকাহ করল, তা পড়ল একজন ধনীর হাতে। যখন সকাল হল তখন লোকজন বলাবলি শুরু করল গত রাতে জনৈক ব্যক্তি এক ধনীকে সাদাকাহ দিয়েছে। একথা শুনে দানকারী বলল, হে আল্লাহ ! ধনীকে সাদাকাহ দেয়ার ব্যাপারে তোমারই প্রশংসা।
আমি রাতে আবার একটি সাদাকাহ করব। যখন পরের রাতে সে সাদাকাহ করল, তা পড়ল একজন চোরের হাতে। যখন সকাল হল তখন লোকজন বলতে শুরু করল, গত রাতে এক ব্যক্তি এক চোরকে সাদাকাহ দিয়েছে। একথা শুনে দানকারী বলল, হে আল্লাহ ! ব্যভিচারী,ধনী ও চোরকে সাদাকাহ দেয়ার ব্যাপারে তোমারই প্রশংসা। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে বলা হল, ‘তোমার সকল সাদাকাহ(দান)-ই কবুল করা হয়েছে। সম্ভবত তোমার সাদাকাহর কারণে ব্যভিচারী মহিলা তার পতিতাবৃত্তি থেকে ফিরে আসবে। ধনী ব্যক্তি আল্লাহর পথে ব্যয় করতে উৎসাহী হবে। চোর তার চুরি কর্ম থেকে ফিরে আসবে। (বুখারী ও মুসলিম)
দেখুন, এ ব্যক্তি তার সাদাকাহ বা দান করার ব্যাপারে এতটাই ইখলাস (আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার নিয়্যত) গ্রহণ করেছিল যে, সাদাকাহ প্রদানে তার অতি গোপনীয়তা কাউকেই বিষয়টি সম্পর্কে জানতে দেয়নি। এ গোপনীয়তা রক্ষার কারণে বার বার এ সাদাকাহ অনাকাংখিত হাতে পড়লেও সে তার ইখলাস থেকে সরে আসেনি। ইখলাস অবলম্বনে সে ছিল অটল। ফলে তার কোন সাদাকাহ ব্যর্থ হয়নি।
ইবনু হাজার রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এ হাদীস দ্বারা বুঝে আসে দানকারী নিয়্যত বিশুদ্ধ থাকলে তার দান অনাকাংখিত হাতে পড়লেও তার দান বা সাদাকাহ আল্লাহর কাছে কবুল হবে। (ফাতহুল বারীঃ ইবনে হাজার)
- ইখলাস বিপদ মুসিবত থেকে মুক্তির কারণ
নিয়তের ব্যাপারে ইখলাস অবলম্বন ও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে আশ্রয় গ্রহণে সততা ও সত্যবাদিতা হল দুনিয়া ও আখিরাতের বিপদ আপদ থেকে মুক্তির মাধ্যম।
বিষয়টি স্পষ্ট করে যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তাদের পূর্বেও পূর্ববর্তীদের অধিকাংশ বিপথগামী হয়েছিল। এবং আমি তাদের মধ্যে সতর্ককারী প্রেরণ করেছিলাম। সুতরাং, লক্ষ্য কর যাদেরকে সতর্ক করা হয়েছিল, তাদের পরিণাম কি হয়েছিল! তবে আল্লাহর একনিষ্ঠ (ইখলাস অবলম্বনকারী) বান্দাদের কথা স্বতন্ত্র।” (সূরা সাফফাতঃ ৭১-৭৪)
আল্লাহ আরো বলেন, “তিনিই তোমাদিগকে জলে স্থলে ভ্রমণ করান এবং তোমরা যখন নৌকারোহী হও এবং আরোহী নিয়ে অনুকূল বাতাস বয়ে যায় এবং তারা এতে আনন্দিত হয়, অতঃপর এগুলো বাত্যাহত এবং সব দিক থেকে তরঙ্গ থেমে যায় এবং তারা তা দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে গেছে মনে করে, তখন তারা আনুগত্য ও ইখলাসে সাথে (বিশুদ্ধ চিত্তে) আল্লাহকে ডেকে বলে- তুমি আমাদেরকে এ থেকে উদ্ধার করলে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হব। অতঃপর তিনি যখনই তাদেরকে বিপদমুক্ত করেন তখনই তারা পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে জুলুম করতে থাকে।” (সূরা ইউনূসঃ ২২-২৩)
এরকম আরেকটি দৃষ্টান্ত, আল্লাহ তায়ালা বলেন, যখন তরংগ তাদের আচ্ছন্ন করে মেঘচ্ছায়ার মত, তখন তারা আল্লাহকে ডাকে তার আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্তে( ইখলাসের সাথে)।