ইতিহাসের আবর্তনের সাথে সাথে মানুষ একের পর এক সভ্যতা গড়ে তুলেছে। সময়ের প্রয়োজনে মানুষ দলবদ্ধভাবে বসবাস করেছে, আর এই জোট বা একতা গড়ে তুলতে গিয়ে সম্মুখীন হয়েছে একটি সাধারণ প্রশ্নের। আর প্রশ্নটি হলঃ কিসের ভিত্তিতে আমরা এই একতা ও ঐক্য গড়ে তুলব ? কিসের ভিত্তিতে আমরা জোটবদ্ধ জীবনের সূচনা করব?
এই ঐক্য কি কোন সাধারণ (common) দেশ (land), অঞ্চল তথা ভৌগলিক সীমারেখার উপর গড়ে উঠবে,
নাকি রক্ত সম্পর্কের উপর ,
নাকি একই ভাষার উপর?
আবার অপরদিকে অনেকে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য ভিত্তি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন আদর্শ, বিশ্বাস, ধ্যান ধারণা আর বিবেক বুদ্ধিকে। পশুদের মধ্যেও একতা আছে, তবে তাদের মধ্যে একতার ভিত্তি কি হবে- এই সমস্যা নেই, কারণ তারা শুধুমাত্র পাশবিক তাড়নাতেই তাড়িত হয়। তাদের স্বাধীনভাবে কোন আদর্শ নির্বাচনের ক্ষমতা নেই, তাদেরকে আদর্শগত, বিশ্বাসগত ঐক্যের কথা বলাটা অর্থহীন প্রলাপ।
কাজেই প্রাণীজগতের মাঝে বন্ধন গড়ে উঠে শুধুমাত্র প্রবৃত্তির ভিত্তিতে, ভূমি-বাসস্থান কিংবা রক্ত-প্রজাতির ভিত্তিতে।
অপরদিকে ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই, মানুষের সাথে মানুষের বন্ধন,ঐক্য গড়ে উঠেছে দুটি ভিত্তিতে। এই দুটি ভিত্তি যেন দুটি সমান্তরাল রেখা, ইতিহাসে ঐক্যের ভিত্তি নির্বাচনের এই দুটি সমান্তরাল রেখা বয়ে চলেছে পাশাপাশি। কিন্তু উভয়ের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান !
১ নম্বর রেখাঃ একটি রেখা ছিল আম্বিয়া(আ)দের, এই রেখাটিধর্ম বিশ্বাসের, যেখানে একতার ভিত্তি ছিল বিশ্বাস ও আদর্শ, আর এ ধরণের আদর্শগত ঐক্যের সর্বোচ্চ উৎকর্ষজনিত মান অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল ইসলামের দ্বারা; বংশ family, গোত্র tribe, বর্ণ color, ভাষা language, ভূগোল land, সাদা-কালো,আরব-অনারব,উঁচু-নিচু নির্বিশেষে একটি বৃহৎ আদর্শগত global জাতি গঠনের মাধ্যমে, যার নাম ইসলামিক উম্মাহ। এমনকি এই আধুনিক সমাজেও যখন বিভিন্ন ধর্মে কিংবা জাতিতে সমাজের নিম্ন বর্ণের মানুষদের অচ্ছুত বা অস্পৃশ্য বলে গণ্য করা হয়, সাদা-কালো বর্ণবাদ লালন করা হয়, রাজনৈতিক সীমারেখা গড়ে তুলে মানুষের চলাফেরা করার ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রিত করা হয় সেখানে ১৪০০ বছর আগে থেকেই ইসলাম শিক্ষা দিয়েছে কালো-সাদা বিভেদ ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সালাত আদায়ের, হজ্জ করার।
২ নম্বর রেখাঃ অপর রেখাটি ছিল পৌত্তলিকতার (মূর্তি কিংবা মানব রচিত মতবাদ) যার ঐক্যের ভিত্তি ছিল ভৌগলিক সীমারেখা, সাদা কিংবা কালো গায়ের রঙ, ভাষা, গোত্র-গোষ্ঠী, পেশী শক্তি আর রাজনৈতিক সংগঠন। মেসোপটেমিয় সভ্যতা, ব্যবিলনীয় সভ্যতা, আদিবাসী সমাজ ব্যবস্থা, গ্রীক, রোম, ইরান-পারস্য, কালডিয়া, আসিরিয়া ইত্যাদি প্রাচীন সভ্যতার সবগুলোর একতার ভিত্তি ছিল এই আসাবিয়াহ জাতীয়তাবাদী প্রভাবকগুলো।
কুর’আনের আয়াতসমূহে এই দ্বিতীয় রেখাটিকে বলা হচ্ছে শয়তান ও তাগুতের রেখা। শয়তান নিজেও তার অহংকার আর শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হিসেবে যা প্রকাশ করেছিল তা হল জাতি-বংশ গৌরব, সে বলেছিল যে সে আগুনের তৈরি তাই সে মাটির তৈরি আদমের (আ) থেকে উত্তম।
আর মানব সমাজে এর সমতুল্য অহংকার হচ্ছে নিজের বংশ, জাতি, ভাষা আর রক্তের বড়াই করা। অথচ আদমের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ ছিল বিবেক বুদ্ধি, জ্ঞান, আদর্শ আর এ কারণেই মাটির তৈরি আদমকে আগুনের তৈরি শয়তানের উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করা হল। আমরা জানি গোত্র, বর্ণ , বংশ কিংবা রক্তের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে আদমকে ফেরেশতাগণ সিজদাহ করেননি বরং তাঁর ইলমের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে আল্লাহর আদেশে ফেরেশতাগণ তাকে সিজদাহ করেছেন।
চলমান সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে আশা করি এতটুকু স্পষ্ট যে,
যখন মানুষে মানুষে একতার ভিত্তি হয় ভূমি কিংবা রক্ত সম্পর্ক সে একতা মানুষেরও আছে আবার পশুদের মাঝেও আছে। মানুষ ও পশু-প্রাণিজগত উভয়ের মাঝেই এটা কমন-সাধারণ, এই ঐক্য কোন বিশেষ বা শ্রেয়তর superior কিছু নয় যার কারণে মানুষ নিজেকে সকল প্রাণীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করতে পারে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভূমি কিংবা রক্তসম্পর্ক কি মানুষের সাথে মানুষের ঐক্য গড়ে তোলার একমাত্র ভিত্তি হবে নাকি এগুলো ছাড়াও অন্য কোন কারণে একতা গড়ে উঠতে পারে? এই প্রশ্নটির উত্তর করার পূর্বে আমাদের জেনে নিতে হবে মানুষের সৃষ্ট বৈশিষ্ট ও বিশেষত্ব সম্পর্কে।
কুর’আনের বর্ণনা অনুসারে, মানুষও একটি পশু, কিন্তু অন্যান্য পশুর সাথে মানুষের পার্থক্য হল মানুষকে রুহ দেওয়া হয়েছে (Divine spirit) যা অন্যান্য প্রাণীদের নেই, অন্যান্য প্রাণীদের রয়েছে কেবল নফস (পশু প্রবৃত্তি)। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, মানুষ এমন একটি বিশেষ প্রাণী যাকে একই সাথে দুটি বিপরীতধর্মী প্রবণতা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, যার একটি অপরটির সাথে সাংঘর্ষিক আর এ দুটোর সমন্বয়েই মানুষের কাঠামো ও স্বভাব চরিত্র গড়ে উঠে। পশু প্রবৃত্তি যা মানুষকে টেনে নিচের দিকে নামিয়ে আনে, মানুষকে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হয়ে নামিয়ে এনে অন্যান্য প্রাণির মতই বানিয়ে দেয়, আর মানবিক প্রবৃত্তি চায় মানুষকে উপরের দিকে তুলতে যা অন্যান্য প্রাণির থেকে মানুষকে বিশেষত্ব ও মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব দান করে। আল্লাহ বলছেন, ‘আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতর অবয়বে। অতঃপর তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি নীচ থেকে নীচে’। (৪-৫, ৯৫)
অন্যান্য প্রাণিদের সাথে মানুষের মিল যেক্ষেত্রে সেটা হল উভয়ের মাঝেই পশু প্রবৃত্তি রয়েছে। কিন্তু কি এই পশু প্রবৃত্তি?
ফ্রয়েড ও ম্যাকডুগাল এর মতে, “প্রবৃত্তি হচ্ছে একটি রহস্যজনক শক্তি যা প্রতিটি জীবের মাঝে কাজ করে, এই প্রবৃত্তি জীবের অগোচরেই বিভিন্ন কাজ করে চলে শারিরীক অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে অথচ সেই জীবটি তা নিয়ে চিন্তা ভাবনার সুযোগও পায় না”।
মানুষের মাঝে, এই প্রবৃত্তিগুলো জেগে উঠে তার পশু প্রবৃত্তি থেকে। এর মধ্যে রয়েছে ক্ষুধা, যৌনতা, লড়াই, ভূমি-বংশ-সম্পদের প্রতি আসক্তি ইত্যাদি।
এই পশুপ্রবৃত্তি থাকার পরেও মানুষ অনেক সময় এগুলো থেকে বের হয়ে আসতে পারে, আর এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব। এই রুহানী প্রবৃত্তি (Divine spirit) তাকে পশু প্রবৃত্তি থেকে বের করে আনে, মানুষের আছে বুদ্ধিমত্তা, বিবেক, ভালো মন্দ যাচাই করার স্বাভাবিক ক্ষমতা (ফিতরাত বা যে স্বভাবের উপর মানব শিশু জন্ম লাভ করে), আছে আত্মসচেতনতা আর আছে বিশ্বাস, ঈমান; এগুলো মানুষের অনন্য বৈশিষ্ট্য, যা অন্য পশুপাখির নেই। মানুষের আরও আছে সবকিছু নিখুঁত করার প্রচেষ্টা, জ্ঞান আর আদর্শ।
মানুষের এই মানবিক আচরণের ‘মূল শক্তির উৎস’ হচ্ছে এই রুহানী প্রবৃত্তি যা মানুষকে পশুদের থেকে বিশিষ্ট ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করে। এ কারণেই আমরা দেখি আদর্শ, মতবাদ আর যাচাই বাছাইয়ের ক্ষমতার প্রয়োগের কারণে মানুষ পশুদের চেয়ে উচ্চ মর্যাদায় আরোহণ করেছে।
এই রুহানী শক্তি এতটাই কার্যকরী ও ক্ষমতাশীল যে এর কাছে পশু প্রবৃত্তি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে মিল ও অমিল তাই সরাসরি এই পশু প্রবৃত্তি থেকে গড়ে উঠে না, বরং তা গড়ে উঠে সচেতনতা, আত্মোপলব্ধি আর ভালো মন্দ যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে।
জাতীয়তাবাদী মাযহাব- (school of nationalism): একারণেই আমাদের কাছে আজ এটা স্পষ্ট, আমরা সহজেই দেখতে পাই কোথায় কোথায় জাতীয়তাবাদের বিচ্যুতি ও ত্রুটি। জাতীয়তাবাদ মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে বেছে নেয় ভূমি land, ভাষা কিংবা রক্তকে blood/caste/color।
ইতিহাস সাক্ষী, কিভাবে কমুনিজম তথা সমাজতন্ত্রে সকল কিছুর মূল চালিকাশক্তি হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিল পেট তথা ক্ষুধাকে, অপরদিকে ফ্রয়েডিয় মতবাদে মানুষের যৌন কামনা বাসনাকেই দেখানো হয়েছে সব কিছুর মূল চালিকাশক্তি হিসেবে, অর্থাৎ এই উভয় দলের মতে মানুষের সকল আচার-আচরণ আর কাজকর্মের মূল প্রভাবক হচ্ছে ক্ষুধা, হতে পারে সেটা খাদ্যের ক্ষুধা কিংবা হতে পারে যৌনতার ক্ষুধা।
এই মতবাদগুলো জোর দেয় মানুষের পশু প্রবৃত্তি উপর, যা মানুষকে অপরাপর প্রাণিদের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব দান করতে পারে না, এমনকি মানুষের উচ্চতর গুণাবলীকে অস্বীকার করে, খারিজ করে দেয় কিংবা খাটো করে দেয়।
আম্বিয়াদের মাযহাব- In the school of the prophets: অপরদিকে নবী-রাসূল(আলাইহিমুস সালাম) দের মাযহাব বা মতবাদে, মানুষের আচার আচরণ, আদর্শ ইত্যাদি বৈশিষ্ট নির্ধারণের মানদণ্ড কিংবা প্রভাবক হিসেবে ভূমি, রক্ত, খাদ্য কিংবা যৌনতাকে অস্বীকার করা হয়েছে। বরং প্রভাবক হচ্ছে মানুষের বিশ্বাস, আদর্শ, নৈতিকতা যার সৃষ্টি হয় জ্ঞান-ইলম, বিবেক-বুদ্ধিমত্তা, সচেতনতা থেকে। এগুলোর কারণেই মানুষ নিজেকে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করে, অন্যান্য সৃষ্টির উপর। সারা বিশ্বকে নিজের পদাবনত করে। যতক্ষণ পর্যন্ত এই মানুষ নিজেকে রক্ত কিংবা ভূমির প্রতি আবদ্ধ করে রাখে, সে পশুদের লেভেলেই আটকে থাকে, কিন্তু যখনই সে বিশ্বাস আর আদর্শের দিকে এক পা বাড়ায়, সে চলে আসে পশুদের লেভেল থেকে উচ্চ লেভেল মানুষের লেভেলে।
সহজাত প্রবৃত্তিগত প্রভাবক আবেগ অনুভূতি যার উপর ভিত্তি করে জাতীয়তাবাদ আর পাশ্চাত্যের ‘তন্ত্র’ সমূহ গড়ে উঠেছে তা ত্রুটিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ; কারণ এগুলো মানুষকে পশুদের লেভেলে নামিয়ে আনে। এমনকি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এগুলো ত্রুটিপূর্ণ কেননা মানুষের নিজস্ব অনন্য গুণ হচ্ছে সচেতনতা, নিজের দুর্বলতা সম্পর্কে অবগত থাকা।
ইতিহাসেই এর প্রমাণ রয়েছে যে, যুগে যুগে দেশে দেশে মানুষের ভোগান্তি আর দুর্ভোগের মূলে প্রধান কারণ ছিল এই প্রবৃত্তিগত মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে ‘ভিশন অব লাইফ’ বা জীবনের লক্ষ্য ঠিক করা।
মানবজাতি একটি পৃথক সত্তা, সে কাক কিংবা কুকুর নয়, গরু কিংবা গাধা নয়। তাকে একতার ভিত্তি হিসেবে অবশ্যই একটি আদর্শকে গ্রহণ করতে হয়, জৈবিক কামনা বাসনা কিংবা আবেগ অনুভূতিকে নয়। তাই সচেতন মানুষেরা জীবনের প্রভাবক হিসেবে বেছে নিয়েছে আদর্শকে, আর প্রত্যাখান করেছে ভূমি-রক্ত-বংশ,সম্পদ ইত্যাদির প্রতি আসক্তিকে, প্রত্যাখান করেছে আসাবিয়াহকে, প্রত্যাখান করেছে এগুলোর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা আদর্শহীন জাতীয়তাবাদকে।
একারণেই আমরা সেই সমস্ত তন্ত্র-মন্ত্র-মতবাদ কে অস্বীকার করি, প্রত্যাখান করি যা মানুষের প্রবৃত্তিজাত, মানুষের নিজের কল্পনাপ্রসূত, আর আমরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি উচ্চতর সত্তা এক অদ্বিতীয় মহান রব, সর্বশক্তিমান আল্লাহর দিকে যার দীন-জীবন বিধান-লাইফ স্টাইলের ভিত্তি ঈমান,আকিদাহ ও নির্ভুলতার উপর, জৈবিক প্রবৃত্তির উপর নয়।
চিরস্থায়ী বন্ধনের সঠিক ভিত্তি কি?
ইসলামের বন্ধনের আরেকটি শ্রেয়তর দিক হল, এটি অন্যান্য সাধারণ ধর্মভিত্তিক বন্ধনের মতন নয়, যা কেবল তাদের ‘ধর্মীয় বিশ্বাস’র কারণে ঐক্যবদ্ধ করে বরং ইসলামের এই বন্ধন গড়ে উঠে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র নিয়ে। ইসলাম বাদে বাকি ধর্মগুলো জীবনের প্রতিটি দিক নিয়ে আলোচনা করে না, এ ধরনের ধর্মীয় বন্ধনের উদাহরণ হতে পারে যখন মানুষে নিজেদেরকে একজন খৃস্টান, একজন হিন্দু কিংবা একজন ইহূদীরূপে চিহ্নিত করে কিংবা পৃথক করে। ইসলামের বন্ধন এ ধরনের আচারস্বর্বস্ব ধর্মের বন্ধনের থেকে উত্তম কেননা ইসলাম একদিকে যেমন ধর্ম তেমনিভাবে এটি হল জীবন ব্যবস্থা বা দীন। দীন’ এর সঠিক অর্থ হল, “একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান”।
এক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি, যদি কেবলমাত্র বিশ্বাস কিংবা উপাসনার পদ্ধতি (ritual)র উপর ভিত্তি করে কোন বন্ধন গড়ে উঠে তা অনেক সীমিত এবং তা সামগ্রিক একতার ভিত্তি হতে পারে না।
আর এখানেই ইসলামের বিজয় কেননা ইসলাম শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান কিংবা অন্তরের বিশ্বাসের নাম নয় বরং একটি জীবন দর্শন, জীবন বোধ , জীবন বিধান। উদাহরণঃ গণতন্ত্র একটি জীবনাদর্শ, যাকে সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হচ্ছে, এবং আমরা দেখতে পাই, এই আদর্শ যা মানুষের খেয়াল খুশি অনুমানের বা ইচ্ছা-প্রবৃত্তির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, এটাকে গ্রহণ/বর্জনের ক্ষেত্রে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী (হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টাণ, ইহুদী ইত্যাদি)দের কোন আপত্তি নেই, বরং একেক জন একেক ধর্মের হওয়া সত্তেও গণতন্ত্রকে জীবন বিধান পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। কিন্তু ইসলাম এই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি রীতি নীতির বিরুদ্ধে, শুধু তাই নয় ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই প্রায় তেরশ বছর মুসলিমরা তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে দেশ রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। বিভিন্ন ভাষা, বিভিন্ন অঞ্চল, বর্ণ, গোত্রের মানুষদের একত্রিত করে এককভাবে মুসলিমরা রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন- আর এই ঐক্যের ভিত্তি ছিল ঈমান।
জাতীয়তাবাদে মানুষের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য বা গঠনগুলো মানুষে মানুষে পার্থক্য সৃষ্টি করে। যেমন- যদি কেউ ভাষার উপর ভিত্তি করে নিজের জাতীয়তা ঠিক করে, সে অন্য ভাষার মানুষকে ভিনজাতি বলে জ্ঞান করে, তাদের মধ্যে একতা হয় না। আবার কেউ যদি নিজের গায়ের রঙ এর উপর ভিত্তি করে নিজের জাতীয়তা ঠিক করে, তাহলে এখানেও একতা আসে না, বরং মারাত্মক বর্ণবাদ সাদা-কালো বিভেদ দেখা যায়। একইভাবে, শারিরীক গঠন- যেমন- ইউরোপিয়ান, আরব, ককেশিয়ান, আফ্রিকান ইত্যাদি ভিত্তিগুলোও বৃহৎ ঐক্যের পথে বাধা, বিভেদ সৃষ্টি করে। এবং- বর্তমান পৃথিবীতে রাজনৈতিক সীমারেখাগুলোও , এক দেশের সাথে আরেক দেশের শাসকদের তুলে দেয়া বর্ডার বা আন্তর্জাতিক সীমারেখা গুলোও জাতিতে জাতিতে বিভেদ যুদ্ধ অশান্তি তৈরি করে রেখেছে।
মূলত- মানব রচিত বিধানগুলো একটি অপরটির সাথে সাংঘর্ষিক বলে- এই কৃত্রিম সীমারেখাগুলো তারা টিকিয়ে রাখে-নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখার জন্য। মোটকথা, এই সবগুলো এককের ভিত্তি নয়, বরং বিভেদের ভিত্তি।
মানুষ শুধু তার দেহ নিয়ে বাঁচে না। বাঁচে তার চেতনা-বিশ্বাস আদর্শ নিয়েও। সে চেতনাটি নিয়ে এ জীবন ও জগতের সর্বত্র তার বিচরণ। সেটি যেমন ধর্ম-কর্ম,রাজনীতি,সংস্কৃতি ও পোষাক-পরিচ্ছদে,তেমনি তার গদ্য,পদ্য,কথা ও গানে। কোন ব্যক্তিকে তার রুহ থেকে যেমন আলাদা করা যায় না,তেমনি আলাদা করা যায় না তার চেতনা থেকেও। মানুষ বেড়ে উঠে এবং তার মূল্যায়ন হয় সে চেতনার গুণে। ইসলামের পরিভাষায় সেটিই হলো তার ঈমান ও আক্বীদা। নামায-রোযা ও হজ-যাকাতের আগে রোজহাশরে আল্লাহর কাছে প্রথমে হিসাব হবে ঈমান ও আক্বীদার। এখানে অকৃতকার্য হলে পাশের আর কোন সম্ভবনাই নাই। শত বছরের ইবাদত দিয়েও সেটি পূরণ হওয়ার নয়। মানুষের ধর্ম,কর্ম,সংস্কৃতি ও আচরনে বিপ্লব আসে তো ঈমান ও আক্বীদের গুণে। এখানে ভেজাল থাকলে ব্যক্তির ইবাদতে বা চরিত্রেও পরিশুদ্ধি আসে না।
মানুষে মানুষে সমস্ত বিভেদ ভুলে বৃহৎ ঐক্য শুধুমাত্র এই ইসলামী চেতনার বলেই আসতে পারে, মুসলিম জাতির ইতিহাস ও ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর ইতিহাস সে কথাই বলে। এখানে আফ্রিকান, এশিয়ান বিরোধ নেই, সাদা কালো আরব অনারব বিভেদ নেই, ভাষার বিরোধ নেই, বরং সমস্ত বিভেদ ভুলে গঠিত হয় ঐক্য।
সংকলনঃ সরল পথ
আগামী পর্ব (ঈমানই ঐক্যের ভিত্তি) শীঘ্রই আসছে ইনশা আল্লাহ।